৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত দিবস

আজ ৭ ডিসেম্বর, নোয়াখালী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে অবিভক্ত নোয়াখালী জেলা পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল।

সেদিন ভোরে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত এবং সি-জোনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোশারেফ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মাইজদী শহরে আক্রমণ চালান। একযোগে তিনটি রাজাকার ক্যাম্প দখল করা হয়। তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পিটিআই ট্রেনিং সেন্টার থেকে পালিয়ে যায়।

পাক হানাদার বাহিনীর পতনের পেছনের প্রস্তুতি

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে সি-জোনের গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর আসে, জেলা শহর মাইজদীতে পাক বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। তৎক্ষণাৎ জোনের রাজনৈতিক প্রধান মরহুম আলী আহম্মদ চৌধুরী ও অন্যান্য কমান্ডাররা জরুরি বৈঠকে বসেন এবং শহরে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন।

১২টি ট্রুপকে রাত ২টার মধ্যে নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিতে বলা হয়। একই সময়ে তৎকালীন নোয়াখালীর ডিসি মঞ্জুরুল করিমের সহায়তায় পুলিশের একটি ইউনিটও মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য ও পিটিআই ক্যাম্পের পতন

৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে বিএলএফ কমান্ডার মাহমুদুর রহমান বেলায়েত ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে মাইজদীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো—ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, নাহার মঞ্জিল, কোর্ট স্টেশন, রৌশনবাণী সিনেমা হল, দত্তের হাট এবং কোল্ড স্টোরেজ—মুক্ত করে।

তবে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ আসে পিটিআই ক্যাম্প থেকে, যা ছিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের মূল ঘাঁটি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারী অস্ত্র না থাকায় ফেনী থেকে আনা ২ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালানো হয়। বিকেলে তিন দফা মর্টার শেলের আঘাতে পিটিআই ক্যাম্পের পতন ঘটে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মাইজদী শহরের সর্বশেষ রাজাকার ঘাঁটিও মুক্ত হয়।

আনন্দের জোয়ার

মাইজদী শহর মুক্ত হওয়ার পর সাধারণ মানুষ আনন্দ মিছিলে অংশ নেয়। পুরো শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি আর মুক্তিপাগল মানুষের উল্লাসে এক অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

মুক্ত দিবসের স্মৃতি সংরক্ষণ

নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি পরিচয় করিয়ে দিতে ১৯৯৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর নোয়াখালী পিটিআইর সামনে স্থাপন করা হয় "মুক্ত নোয়াখালী" স্মৃতিস্তম্ভ। পরে একই স্থানে বর্ধিত পরিসরে নির্মিত হয় "নোয়াখালী মুক্ত মঞ্চ"।

নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে নোয়াখালীর ছাত্র-জনতা, পুলিশ এবং ইপিআর সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত নোয়াখালী মুক্ত ছিল। পরবর্তীতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।

এরপর পাকিস্তানিরা নোয়াখালী পিটিআই এবং বেগমগঞ্জ সরকারি কারিগরি বিদ্যালয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে লুটপাট শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পুনরায় আক্রমণ শুরু করেন। কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যুদ্ধে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

ডিসেম্বরের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমণ চালিয়ে ৬ ডিসেম্বর বেগমগঞ্জ এবং ৭ ডিসেম্বর পুরো নোয়াখালীকে শত্রুমুক্ত করেন।

Post a Comment

0 Comments